কাছে-দূরে

কাছে-দূরে

কমরুজ্জামান কবির

এভাবে থাকার চেয়ে না থাকাই বোধয় ভালো। এটা যন্ত্রণার, দুঃখের হেতু, অপমানের, আত্মসম্মানহীনতার কারণ, মন ভেঙে যাওয়ার বিষয়! সুনামি আসলে যেমন স্রোতে ভেসে যাওয়া ছাড়া করার কিছুই থাকে না, এ যেন সেরকম্ ভেসে চলা, ভূমিকম্পে বিদ্ধস্ত বাড়িঘরের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে পড়ে থাকলে যেমন সহ্য করা ছাড়া, প্রাণ বিসর্জন দেওয়া ছাড়া করার কিছুই থাকে না, এ যেন সেরকমই নিজেকে বিসর্জন দেওয়া; পাহাড়ের চূড়া থেকে কোনো পাথরখণ্ড পড়ে গেলে যেমন সে কতদূর ছুটে চলবে, কখন তার সেই দুঃসহ ছুটে চলার গতি কোথায় আঘাত পেয়ে থামবে সেই নিয়ন্ত্রণে তার হাতে নেই- এ যেন সেরকমই ছুটে চলা! এভাবে ভাবতে ভাবতে বিপ্লবের রাত পার হয়, রাত পার হয়ে ভোর আসে, সূর্য ওঠে, দুপুর হয়, বিকেল-সন্ধ্যা গড়িয়ে আবার রাত। এ যেন কালরাত! কাটতে চায় না। আবার সেই পাশাপাশি থাকা, নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়, অথচ সেখানে সৌরভ নেই; মাটির ফুল ফুটে আছে, অথচ স্নিন্ধ সুবাস নেই! নদী আছে, অথচ ঢেউ নেই, নৌকা ভাসে না, দাঁড় বায় না মাঝি! এ যেন স্বর্গের একটা মায়াবি গাছ- দূর থেকে দেখলে মনে হয় জীবন আছে, সবকিছু স্বাভাবিক আছে, দূরের মানুষেরা সেটাই ভাবে; কাছে আসলে দেখা যায় সেই গাছটা শুকিয়ে পড়ে আছে, অথবা জীবাষ্ম হয়ে গেছে!

কেন এমন হয় বিপ্লব জানেও সেটা, তবু করার যেন কিছুই নেই! উত্তরণের উপায় খোঁজে, অথচ দ্রুত সমাধানের উপায় নেই, সমাধান যে হবে, এই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে যে বেরিয়ে আসবে, নিকটদূরে তারও কোনো সম্ভাবনা নেই! অথচ এখান থেকে বেরিয়ে আসার তাড়না সারারাত ঘুমোতে দেয় না বিপ্লবের। দিনের গনগনে সুর্যের আলোকেও মেঘ মনে হয় তার কাছে! চাঁদের আলোকে মনে হয় শোকের বৃষ্টি! এ যেন দূরে থাকা- এমন দুরে, যেন সেই নক্ষত্রের মাঝে থাকা, যেই নক্ষত্রের আলো এখনো পৃথিবীতে এসে পৌঁছেনি! ঠিক যেমন দূর থেকে খালি চোখে দেখা যায়- তারাগুলো, নক্ষত্রগুলো পরস্পরের কতো কাছে অথচ এগুলোর মাঝে কতো তফাত, কত লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে তাদের মধ্যকার অবস্থান!

একসাথে জীবন পার করার প্রতিজ্ঞা করেছিল বিপ্লব আর মুক্তি। সেই সূত্রে প্রায দেড় যুগের পথচলা। তারা ভাবতো- পরস্পরে জড়িযে থাকবে, আদরে আদরে মাতাল করে রাখবে দুজনার পৃথিবী, দুজনের নিঃশ্বাসের সংঘর্ষে উষ্ণ হবে আবহাওয়া, বৃষ্টি ঝরবে, শীতল বাতাস বইবে, শান্ত হবে, বাড়ির আঙিনায় খেলবে পাখিরা…
কল্পণার জগতে সবকিছুই সুন্দর- সাজানো-গোছানো, প্রেমময়। কল্পণার জগতটাই হয়তো এমন- সেখানে উল্লাস আছে, আনন্দ আছে, স্বপ্নের বিভরতা আছে, রোম্যাঞ্চ আছে, উত্তেজনা আছে, আছে সুখ আর সুখ, আছে অধিকার, কিন্তু কর্তব্য নেই; অথচ বাস্তব জীবনে অধিকারের চেয়ে কর্তব্য বেশি, দায়িত্ব বেশি। সেই কর্তব্য আর দায়িত্ব হলো- স্বপ্ন পুরণের কর্তব্য, সুখে রাখার কর্তব্য, ভালো রাখার কর্তব্য সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার কর্তব্য, ক্ষমতা দেখানোর কর্তব্য, বিখ্যাত হওয়ার কর্তব্য, সকল সমস্যা তুড়ি মেরে উড়িয়ে বিজয়ী হওয়ার কর্তব্য, ইচ্ছে হলেই পাখির মতো উড়ে উড়ে এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়ানোর আয়োজেনের কর্তব্য, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধবকে খুশি রাখার কর্তব্য সেজন্যই হয়তো কল্পণা সুন্দর, বাস্তবতা কঠিন! এতোসব দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আসলে ভালোবাসাবাসির সময়টাই হয়তো হারিয়ে যায়, রোম্যাঞ্চ, বিভরতা, উত্তেজনায় ভাটা পড়ে, দূরত্ব বাড়তে থাকে, কাছে থেকেও যেন কতো দূরে চলে যায় প্রিয় মানুষেরা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *